সাধারণত নিম্নবিত্তের খেটে খাওয়া মানুষদেরই শ্রেণিভুক্ত রিকশা চালকরা। সকাল-সন্ধ্যা মাথার ঘাম পায়ে ফেলেও তাদের অনেকের সংসারে অচলাবস্থা। রিকশার চাকা উজান ঠেলে এগোলেও জীবনের চাকা তাদের বরাবরই শ্লথ। অভাব-অনটনে কোনও রকম খেয়ে না খেয়ে তাদের দিন চলে যায়। তবে রাজধানী ঢাকার বুকে এমনও রিকশাচালক আছেন যারা অভাব আর জীবনের তাগিদেই নয়, রিকশা চালায় স্বভাবে। তেমনই তিন রিকশাচালকের সঙ্গে কথা হয়েছে ব্রেকিংনিউজ.কম.বিডি’র এ প্রতিবেদকের।
গেল বৃহস্পতিবার ঘড়ির কাটায় তখন ভোর ৪টা। রাজধানীর পল্টন মোড় একেবারেই সুনসান। দিনে যেখানে মানুষ আর যানবাহনের চাপে পা বাড়ানোই ভয়, ভোরের সেই পল্টন মোড়ের দৃশ্য পুরোই বিপরীত। দু-একটা সিএনজি আর দু-একটি রিকশা ছাড়া আলো-আঁধারির চারপাশাটায় খা খা নীরবতা। সেখানেই ইমাম হোসেন নামে এক রিকশা চালকের সঙ্গে কথা হয়। অভাবে নয়, শরীর সুস্থ ও ফিট রাখতেই যিনি রাতের ঢাকায় রিকশা চালান। তার গ্রামের বাড়ি কিশোরগঞ্জে। তিনি মগবাজারের ডাক্তার গলিতে থাকেন। স্ত্রী, তিন ছেলে ও তিন মেয়ে নিয়ে তার সংসার। বড় দুই ছেলে চাকরি করেন।
ইমাম হোসেন ব্রেকিংনিউজকে জানান, বড় দুই ছেলে চাকরি করেন। বাকি চারজন পড়াশোনা করে। আল্লাহর রহমতে তার সংসার ভালোই চলছে। ওইদিন (বৃহস্পতিবার) রাতে এ প্রতিবেদন লিখা পর্যন্ত তার ১২০টা কামাই হয়েছে। এটুকুই তার যথেষ্ট।
শরীর ঠিক রাখতে এত কষ্ট করে রাত জেগে রিকশা চালান কেন- জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘রিকশা চালাই সুস্থ থাকার জন্য। রিকশা চালানো বাদ দিয়ে ঘরে বসে থাকলে তো অসুস্থ হয়ে পড়বো। তখন তো মহাবিপদ ঘাড়ে চাপবে। রাতে রিকশা চালানো পুরনো অভ্যাস। তাই রাতেই বের হই। আমার শরীরও সুস্থ থাকে। আবার কিছু টাকা ইনকামও হয়।’
সেখানে পাশেই রিকশা নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা আমির হোসেন অবশ্য ইমাম হোসেনের মতো স্বভাবে রিকশা চালান না। সংসারের অভাব-অনটন কিছুটা দূরে রাখতে রাতেও তাকে রিকশা নিয়ে বের হতে হয়। তার গ্রামের বাড়ি ময়মনসিংহ। রাজধানীর খিলগাঁও তালতলায় থাকেন। স্ত্রী, এক ছেলে ও এক মেয়ে নিয়ে তার সংসার। তার ছেলে অনার্সে পড়াশোনা করেন। মেয়েটা ক্লাস ফাইভে।
আমির হোসেন ব্রেকিংনিউজকে বলেন, ‘খুব অভাবের সংসার। কিছু টাকা বেশি ইনকামের জন্য রাতে রিকশা চালাই। কিন্তু বর্তমান অবস্থা খুবই খারাপ। বেশি ইনকাম হচ্ছে না। সংসার চালানো ছেলেমেয়ের পড়াশোনার খরচ জোগাড় করতে হিমশিম খাচ্ছি। এমন অবস্থা হয়েছে যে হয়তো ছেলে-মেয়ের পড়াশোনাই বন্ধ করে দিতে হবে। আজ সারারাত মাত্র ৪০০ টাকা ইনকাম করেছি। এরমধ্যে ২০০ টাকা রিকশার মালিককে দিতে হবে। বাকি ২০০ টাকা আমার থাকবে। সারারাত কষ্ট করে রিকশা চালিয়ে যদি ২০০ টাকা ইনকাম করি তাহলে সংসার চলবে কিভাবে? আর ছেলে মেয়ের পড়াশোনার খরচই বা দিবো কিভাবে?’
প্রতি রাতে কি একইরকম ইনকাম হয়- জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘কমও হয় আবার বেশিও হয়। তবে করোনার পর থেকে ইনকাম খুবই কম।’
ইনকাম দিনে বেশি নাকি রাতে- ‘দিনে বেশি ইনকাম হয়। তবে দিনের বেলায় পুলিশ বেশি ঝামেলা করে। এজন্য আমি রাতে চালাই। রাতে পুলিশ তেমন ঝামেলা করে না। রাস্তাও থাকে ফাঁকা।’
আমির হোসেন বলেন, ‘আর কয়েকটা বছর যদি ভালো করে রিকশা চালাইতে পারতাম- ছেলের পড়াশোনা শেষ হলে সে কিছু একটা করতে পারতো, তাহলে আমাকে আর এত চিন্তা করতে হতো না। কিন্তু মাঝপথে এসেই হয়তো ছেলেটার পড়াশোনা বন্ধ করে দিতে হবে।’
কারও কোন সহযোগিতা চেয়েছেন বা পেয়েছেন কি না- জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘করোনার সময়ই কারও সহযোগিতা পাই নাই। আর এখন কিভাবে পাবো?’
তাদের সাথে কথা বলতেই আরেকজন রিকশা চালক এসে দাঁড়ালেন পল্টনের এই মোড়ে। তার নাম রিপন মিয়া। তিনি স্বাভাবে ও বন্ধুত্বের জন্য রাতে ঢাকায় রিকশা চালান। তার গ্রামের বাড়ি গাজীপুরের মাওনায়। তিনি গ্রামের বাড়িতেই থাকেন। একদিন পরপর ঢাকায় এসে সারারাত রিকশা চালান, সকালেই বাড়ি ফিরে যান।’
এতদূর থেকে এসে রিকশা চালান কষ্ট হয় না- রিপন মিয়া বলেন, ‘স্বভাব হয়ে গেছে। তাই এখন আর কষ্ট লাগে না। আর বেশিরভাগ বন্ধু-বান্ধব ঢাকাতেই থাকে। তাদের সাথে দেখা-সাক্ষাৎ হয়, আড্ডা দেই। এছাড়া ঢাকার অলিগলিও চিনি আমি। আর এজন্যই আমি গাজীপুর থেকে ঢাকায় এসে রিকশা চালাই।’
‘আজ (বৃহস্পতিবার) সারারাত রিকশা চালিয়ে ১০০০ টাকা ইনকাম করেছি। সকাল ৯টা পর্যন্ত চালাবো। এরপরে বাড়ি চলে যাবো। আবার একদিন রেস্ট করে আবার ঢাকায় আসব রিকশা চালাতে।’
ব্রেকিংনিউজ/এএইচএস/এমআর